রসায়ন


আতশবাজির ভেতরের গল্প
হাসানুজ্জামান মামুন


সবাই পার্কে, খেলায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অথবা বর্ষবরণ উৎসবে আতশবাজি দেখেছি। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি এত মনোমুগ্ধকর রঙ,শব্দ আর ইফেক্ট সমন্বয় করা হয় কিভাবে? এর পিছনের বিজ্ঞান নিয়ে আমরা অনেকেই জানি না। প্রতিটি আতশবাজিকে জ্বালানি দ্রব্য আর রাসায়নিক দ্রব্যের সূক্ষ্ম সমন্বয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন একটি বিশেষ “ইফেক্ট” তৈরি হয়। একটি আতশবাজির বৈচিত্র্যময় রঙ, অসাধারণ গঠন আর চমকপ্রদ শব্দ বোঝার জন্য কয়েকটি সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়া বোঝা প্রয়োজন।

          আতশবাজির বিস্ফোরণের সময় একসাথে শক্তির তিনটি ভিন্ন রূপের সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড গতিতে শব্দ, আলো আর তাপ মুক্ত হবার কারণে শব্দের চেয়ে দ্রুত গতিতে বাতাস সম্প্রসারিত হয়ে একটি “সাউন্ড-ওয়েভ” সৃষ্টি করে এবং ভূমি থেকে আমরা প্রচণ্ড গর্জন শুনতে পাই।

          যেসব ধাতব লবণকে তাপ দিলে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যমূলক বর্ণ প্রদর্শন করে (যেমন-ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড অথবা সোডিয়াম নাইট্রেট), আতশবাজিতে সেই লবণ গুলো ব্যবহার করা হয়। লবণের অণুগুলো তাপশক্তি শোষণ করে এবং পরে সেই শক্তি বিভিন্ন বর্ণ হিসেবে নির্গত করে। একটি অণুর শোষিত শক্তি এর ইলেকট্রনগুলোকে সর্বনিম্ন শক্তিস্তর থেকে সর্বোচ্চ শক্তিস্তরে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত শক্তি আলো হিসেবে নির্গত হয় ইলেকট্রনগুলো আবার নিম্নস্তরে ফিরে আসে। কি পরিমান আলো নির্গত হবে তা শক্তির পরিমানের উপর নির্ভর করে এবং শক্তির পরিমাণ ব্যবহৃত যৌগের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। উদাহরণসরূপ- সোডিয়াম নাইট্রেটকে তাপ দিলে এর অণুসমূহ শক্তি শোষণ করে এবং প্রায় ২০০ কিলোজুল/মোল শক্তি উৎপন্ন করে যা আমরা হলুদ আলো হিসেবে দেখতে পাই।

          প্রতিটি যৌগের শক্তি নির্গমনের পরিমাণ ভিন্ন হয়। আমরা এই শক্তিকে আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য দ্বারা পরিমাপ করতে পারি। বেশি পরিমাণ শক্তি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য উৎপন্ন করে যা দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর বেগুনী/নীল প্রান্তের কাছাকাছি হয়,ঠিক তেমনি শক্তির পরিমাণ কম হলে বড় তরঙ্গ উৎপন্ন হয় যা দৃশ্যমান বর্ণালীর লাল প্রান্তের কাছাকাছি থাকে।


বর্ণ
যৌগ
তরঙ্গদৈর্ঘ্য(ন্যানোমিটার)
লাল
স্ট্রনটিয়াম এবং লিথিয়াম লবণ
লিথিয়াম কার্বনেট (Li2CO3)= লাল
স্ট্রনটিয়াম কার্বনেট (SrCO3)=উজ্জ্বল লাল
৬৫২
কমলা
ক্যালসিয়াম লবণ
ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCl2)
৬৬৮
হলুদ
সোডিয়াম লবণ
সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl)
৬১০-৬২১
সবুজ
বেরিয়াম যৌগ এবং ক্লোরিন যৌগ
বেরিয়াম ক্লোরাইড (BaCl2)
৫৮৯
নীল
কপার যৌগ এবং ক্লোরিন যৌগ
কপার(I) ক্লোরাইড (CuCl)
৫০৫-৫৩৫
বেগুনী
স্ট্রনটিয়াম এবং কপার যৌগের মিশ্রণ
৪২০-৪৬০
রুপালী
এলুমিনিয়াম,টাইটেনিয়াম অথবা ম্যাগনেসিয়াম এর প্রজ্বলন
২২০


আতশবাজির রসায়নঃ  
       
          একটি আতশবাজিতে তিনটি অংশ থাকে। জারক, বিজারক এবং রঞ্জক। ধাতব লবণই রঞ্জক হিসেবে কাজ করে। আতশবাজিতে অগ্নিসংযোগের পর ব্ল্যাক “পাউডার” উড্ডয়নের শক্তির যোগান দেয়। ব্ল্যাক পাউডার হল ধীর প্রজ্জলন ক্ষমতা সম্পন্ন যৌগ যাতে ৭৫% পটাশিয়াম নাইট্রেট, ১৫% কাঠকয়লা এবং ১০% সালফার থাকে।

          আতশবাজিতে অগ্নিসংযোগের পর কতগুলো জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং এর ফলেই তৈরি হয় মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং শব্দ। জারকসমূহ অক্সিজেন গ্যাস সরবারহ করে যা বিজারকদের জ্বালাতে এবং যৌগগুলোকে উত্তেজিত করতে সাহায্য করে। ব্যবহৃত জারকসমূহের মধ্যে রয়েছে নাইট্রেট, ক্লোরেট এবং পারক্লোরেট। বিজারক,সালফার এবং কার্বন, জারক থেকে উৎপন্ন হওয়া অক্সিজেনের সাথে মিশে বিস্ফোরণের শক্তি যোগায়।

          প্রথম দিকে ব্ল্যাক পাউডারের প্রধান উপাদান নাইট্রেটসমূহই ছিল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জারক। অধিকাংশ সময় পটাশিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হত যা ভেঙে পটাশিয়াম অক্সাইড, নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন গ্যাস দেয়

4KNO3 --- 2K2O + 2N2 + 5O2

                 বিক্রিয়ার সময় নাইট্রেট দুটি অক্সিজেন অণু ছেড়ে দেয়। কারণ এক্ষেত্রে সবগুলো অক্সিজেন অণু ছেড়ে দিলে জারণ বিক্রিয়া ঘটে না। অন্যান্য জারণ বিক্রিয়ার মত এই বিক্রিয়াটি খুব শক্তিশালী এবং অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। এই জন্যই ব্ল্যাক পাউডারের প্রধান উপাদান হিসেবে নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়। আতশবাজিতে তাদের কাজটাই হল উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ধাক্কা সৃষ্টি করা এবং ছোট ছোট বিস্ফোরণগুলো ঘটানো।

           ১৮৩০ সনের দিকে ইটালিয়ান আতশবাজি প্রস্তুতকারীরা আরও শক্তিশালী একটি জারক খুঁজে পেলেন যা কিনা ১৭০০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত তাপমাত্রা তৈরি করতে পারে এবং আরও গাঢ় রঙ সৃষ্টি করে। এই জারক হল ক্লোরেট যাদের ক্লোরাইড(ClO3-) আয়ন আছে এবং এরা বিক্রিয়ার সময় এদের সকল অক্সিজেন মুক্ত করে দেয়।

2KClO3 --- 2KCl + 3O2
               
                এই বিক্রিয়া আরও বেশি তীব্র এবং আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু ক্লোরেট নাইট্রেট থেকে অনেক কম স্থিতিশীল এবং যথেষ্ট বিপদজনক। এরা এতটাই অস্থিতিশীল যে শুধুমাত্র মাটিতে ফেলে দিলেই এরা বিস্ফোরিত হয় এতসব অসুবিধা সত্ত্বেও ক্লোরেট নাইট্রেট অপেক্ষা ভাল জারক আতশবাজির ক্ষেত্রে। ক্লোরেটসমূহ আতশবাজিতে বিস্ফোরণ ঘটায় যেখানে নাইট্রেট ধীর গতির প্রজ্বলন ঘটায়। কিছু কিছু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্লোরেট ব্যবহার করলেও ইদানীং প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই পারক্লোরেট কে বেছে নেয়।

          পারক্লোরেটে পারক্লোরেট(ClO4-) আয়ন বিদ্যমান যেখানে প্রতিটি ক্লোরিন পরমাণু চারটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত। যেহেতু ক্লোরিন তার সর্বোচ্চ সংখ্যক অক্সিজেনের সাথে যুক্ত তাই পারক্লোরেট ক্লোরেট অপেক্ষা অনেক বেশি স্থিতিশীল। তারপরও পারক্লোরেট সবকটি অক্সিজেন ছাড়তে পারে।

KClO4 --- KCl + 2O2

                সুতরাং, পারক্লোরেট ক্লোরেটের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল এবং এরা ক্লোরেটের চেয়ে বেশি অক্সিজেন ছাড়তে পারে। তাই এরা জারক হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত। এরাই সবচেয়ে শক্তিশালী বিক্রিয়া ঘটায় এবং সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ফলাফল দেয়। নাইট্রেট, ক্লোরেট এবং পারক্লোরেট থেকে নির্গত অক্সিজেন খুব দ্রুত বিজারকের সাথে বিক্রিয়া করে প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে এবং গ্যাস নিঃসরণ করে। বহুল ব্যবহৃত দুইটি বিজারক হল সালফার এবং কার্বন(কাঠকয়লা)। এরা ব্ল্যাক পাউডারের উপাদান এবং এরাই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে সালফার ডাই অক্সাইড এবং কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন করে।

S + O2 --- SO2
C + O2 --- CO2

           এই বিক্রিয়াসমূহ থেকে গ্যাসের পাশাপাশি অনেক তাপও উৎপন্ন হয় যা আশেপাশের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই তাপ আর গ্যাস এত দ্রুতগতিতে ছরিয়ে পড়ে যে এর কারণে বিস্ফোরণের গতি বৃদ্ধি পায়।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন