বিদ্যুৎ(পর্ব-১)
ফারহান
আল রাজ
ধ্যাত! মোবাইলটা এই মুহুর্তে কোন কাজেই আসছে
না। চার্জ নেই যে! ওদিকে কম্পিউটার টাও বন্ধ, বাসায় বৈদ্যুতিক তারের কাজ চলছে। একজন ইলেক্ট্রিসিয়ান এক মনে কাজ করে যাচ্ছে। এমন সময় ভাবছি, আজকে ঘুম থেকে উঠে যা যা ব্যবহার করলাম সবই
তো বিদ্যুৎ এর অবদান। লাইট, ফ্যান, পানির মটর, ইস্ত্রী, টেলিফোন, ঘড়ি, টিভি এমনকি গ্যাসের চুলাটাও কোন না কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্রে তৈরী। ‘বাহ্! ভালোই তো!’ আমি চিন্তাটা
আরেকটু গভীরে নিয়ে গেলাম...।
যদি বলি আচ্ছা, কীভাবে এই বিদ্যুৎ তৈরী হয়? “আরে, এইটা কোন প্রশ্ন হল? খুবই সোজা। জেনারেটরের মাধ্যমে, ব্যাটারি দিয়ে; প্রথমটা
যান্ত্রিক আর পরেরটা রাসায়নিক পদ্ধতি; আরো আছে অনেক।” বুঝলাম, কিন্তু যাকে নিয়ে এত কথা সে কী? মানে বিদ্যুৎ কী? উত্তরটা আমাদের
এখনো অজানা! শুনতে অবাক লাগবে কিন্তু আপনি এর উত্তর এখানে বা অন্য কোনখানে খুঁজে পাবেন না! কেউই বলতে পারবে না, এমনকি কোন
বিখ্যাত বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীও আপনার এই
প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারবে না। তাঁরা শুধু তাঁদের ধারনা দিতে পারবেন এই ব্যাপারে যে বিদ্যুৎ কী হতে পারে কারণ কেউই বলতে পারে
না আসলে বিদ্যুৎ কী।
“বিদ্যুৎ” এমন একটি জিনিসের নাম যেটা কেউ দেখে নাই আর যার প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়। আপনি অবশ্য বলতে পারেন,
“কিন্তু যখন আমাদের শক্ লাগে আমরা বিদ্যুৎ অনুভব করি না? বা যখন কোন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ দেখি তখন কী আমরা বিদ্যুৎ দেখতে পাই না? উত্তর হল ‘না’। আমরা কখনই একে দেখতে, শুনতে বা অনুভব করতে পারি না। আমরা শুধু সেটা দেখি, শুনি বা অনুভব
করি যেটা বিদ্যুৎ তার ক্রিয়াকলাপ এর মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রকাশ করে, আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, আমরা একটা উজ্জ্বল টিউব লাইট থেকে আলো দেখতে পারি, ফোনে বহু দূর
থেকে আসা শব্দ শুনতে পারি এবং বৈদ্যুতিক স্ত্রী হতে আসা তাপ অনুভব করতে পারি কিন্তু এই কয়টা ঘটনার কোনটাতেই বিদ্যুৎ জিনিসটাকে আমরা দেখতে
পাইনি শুধু তার উপস্থিতির ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। এমনকি
আমরা যখন বজ্রপাত দেখি তখন কোন বিদ্যুৎকে দেখতে পাই না বা শুনি না আমরা শুধু একটা উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখি আর শব্দ
শুনি যেটা বিদ্যুৎ এর উপস্থিতিতে তৈরী হয়।
এর প্রকৃত রূপ আমাদের কাছে রহস্যময় থাকলেও বিদ্যুৎশক্তি আমাদের এত কাজে
দরকার হয় যে একে মানবজাতির সেবক বললেও অত্যুক্তি হবে
না। কিন্তু এই অবস্থা সবসময়ই বিরাজমান ছিল না। আজ হয়ত আমরা কম্পিউটার, টিভি, মোবাইল ফোন, লিফট্ বা আরো অনেক বিস্ময়কর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি দেখতে পাই তবে পৃথিবীর ইতিহাসের একটা বড় অংশ জুড়ে
বিদ্যুৎ ছিল শুধুই ভেল্কিবাজী বা বিজ্ঞানের খেলা
দেখানোর বস্তু। কারণ একে তখনো আয়ত্তে আনার প্রয়োজনীয় জ্ঞান মানুষের ছিল না। আজ থেকে কমবেশী দেড়শ বছর আগে মানুষ একে
প্রথম ব্যবহারিক কাজে লাগানো শুরু করে আর বিদ্যুৎ
শুধুমাত্র খেলনা জিনিস থেকে এক প্রয়োজনীয়
শক্তি রূপে আবির্ভাব হয়। ঐ সময় এর ধারণা গুলো লিপিবদ্ধ করা হয়ত একটা ছোট বইয়ের ভিতর ই করা যেত কিন্তু এখন আমরা যা জানি বিদ্যুৎ এর ব্যাপারে তাতে
পুরো একটা বিশাল লাইব্রেরী ভর্তি করে ফেলা যায় তবে এখন
তার আর দরকার হয় না, আমরা বৈদ্যুতিক সংকেত হিসাবে তথ্যগুলোকে
পেনড্রাইভ বা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে রেখে দিতে পারি! এভাবেই প্রতিনিয়ত আমাদের সর্বক্ষেত্রে বিদ্যুৎ অনস্বীকার্য।
হুমম! ব্যাপারটা ভালোই লাগছে। চলুন, আমাদের চিন্তাভাবনাটা আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই কী বলেন? আচ্ছা বলছি শুনুন। এই লেখার প্রথম দিকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল মনে আছে? বিদ্যুৎ কীভাবে তৈরী হয়? এইখানেও একটা ভুল করে থাকি আমরা। বিদ্যুৎ “তৈরী” বা “উৎপন্ন” করা যায় না, একে কোন এক জায়গায় জড়ো করে ব্যবহার করা যায় মাত্র। নানা অদ্ভুত আর অভাবনীয় উপায়ে বিদ্যুৎ কে তার লুকিয়ে থাকা জায়গা থেকে উদ্ধার
করা যায় আর এই উদ্ধার প্রক্রিয়াকেই আমরা উৎপাদন বলি।
চুম্বক, রাসায়নিক বস্তু, আলো তারপর ঘর্ষন এরকম বহু কিছু দিয়েই
বিদ্যুৎ পাই আমরা। পৃথিবীর প্রথম বিদ্যুৎ এর সন্ধান ঘর্ষনের মাধ্যমেই পাওয়া গিয়েছিল। আমরা সবাই হয়ত এই মজার ব্যাপারটার সাথে পরিচিত-
শুকনো আবহাওয়ায় একটা প্লাস্টিকের কলম দিয়ে
মাথায় ঘষে কয়েক টুকরো কাগজের উপর ধরলে টুকরা গুলো লাফিয়ে কলমের গায়ে লেগে যায়, এটাও বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার একটা ফল।এমনকি
একটা পেন্সিল কাটার সময়ও ব্লেড এর সাথে এর ঘষায়
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
বিদ্যুৎ এর উৎপাদন আর এর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়ার
উপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ কে দুই ভাগে ভাগ করা
হয়েছে এটা আমরা সবাই জানি; এর একটি হল “স্থির তড়িৎ” অবশ্যই তড়িৎ বলতে আমরা বিদ্যুৎ ই বুঝি। এই নামকরণের কারণ হল এই তড়িৎ যে জায়গায় উৎপন্ন হয় সাধারণত সেখানেই অচল অবস্থায় স্থির হয়ে থাকে। এই
ধরণের তড়িৎ ঘর্ষণের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় বলে একে “ঘর্ষ তড়িৎ” ও বলে। কিন্তু আমাদের ঘরের আলো জ্বালাতে, ফ্যান, মটর, টিভি বা ফ্রিজ চালাতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি সেটা কিন্তু স্থির তড়িৎ নয়। এটা উৎপন্ন হয় চুম্বকের চৌম্বক ধর্ম কাজে লাগিয়ে আর এটি
পাইপে প্রবাহিত পানির মত প্রবাহিত হয়। এই চলার
ক্ষমতার জন্য এই বিদ্যুতের নাম “চল তড়িৎ” আর চলতড়িৎ এর
প্রবাহকে আমরা বিদ্যুৎ প্রবাহ বা কারেন্ট বলে থাকি। স্থির বিদ্যুৎ এর চাইতে এটি অনেক মুল্যবান কারণ চলবিদ্যুৎ কে বেশী কাজে লাগান যায়। একই কথা
ঠিক, যে বিদ্যুৎ আমরা ব্যাটারি থেকে পাই তার জন্য।
তাই আমাদের পরের আলোচনা এই চলবিদ্যুৎ নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমরা দেখব কীভাবে আমাদের প্রতিদিনের বিদ্যুতের
চাহিদা পূরণ হয় আর এর পিছনে কাদের অবদান আছে। এই মুহুর্তে অনেকেই বলতে পারেন, “আরে কিসের মধ্যে কী? বিদ্যুৎ এর
আলোচনায় ব্যাঙের ঠ্যাং আসল কোত্থেকে?” হ্যাঁ জনাব, এরকম একটু আধটু হয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক মহান আবিষ্কার শুরু হয়েছে অনেক ছোটখাট ব্যাপার দিয়েই। একটা চায়ের কেট্লি
দিয়ে বাষ্প বের হতে দেখেই জেমস্ ওয়াট এর
বাষ্পীয় ইঞ্জিন এর চিন্তা মাথায় আসে, মন্টগলফিয়ার ভ্রাতৃদ্বয় চিমনি থেকে ধোঁয়া
উড়তে দেখে প্রথম বেলুন আবিষ্কার করেন আর নিউটনের আপেল গাছের কাহিনি তো সবাই জানি। ঠিক এরকম ভাবেই ব্যাঙের পিছন
দিকের একটা ঠ্যাং ই প্রথম “ব্যাটারী” বানানোর চিন্তা
মানুষের মাথায় আনে। যখন আপনি আপনার টিভি রিমোটের পুরনো ব্যাটারী পাল্টান বা মোবাইলের নতুন ব্যাটারী কিনে আনেন তখন হয়ত
আপনার চিন্তাটা স্বাভাবিক ভাবেই ঠিকঠাক মত রিমোট বা
মোবাইলটা কাজ করছে কিনা তার উপর থাকে কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য আপনার হাতদুটো এমন একটা জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে যেটা ইতিহাসের অন্যতম সেরা আবিষ্কার। যে আবিষ্কারের ফলে আমরা বুঝতে পেরেছি যে “রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব এবং এটা একটা স্থিতিশীল প্রবাহ (কারেন্ট বা Current) যা বহু সময় ধরে চলমান থাকে” এই ঘটনা স্থির
বিদ্যুৎ এর বৈশিষ্ট্য থেকে অনেক উন্নত ও কাজের কারণ স্থির বিদ্যুৎ এর চলাচল সীমিত আর কিছুক্ষনের ভিতরই এটা উবে
যায়। যাই হোক চলবিদ্যুৎ এর প্রথম এবং
বহুল প্রচলিত উৎস ব্যাটারী সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের ব্যাঙ থেকেই শুরু করতে হবে। ব্যাটারির গল্প
আরেকদিন হবে।
khub valo hoyese shob gului joss
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনখুব ভাল
উত্তরমুছুন